রক্ত দানের উপকারিতা ও অপকারিতা - রক্তদানের ১০টি উপকারিতা
রক্তদানের ১০টি উপকারিতা- রক্ত আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রক্তের মাধ্যমে আমাদের দেহ সচল থাকে। রক্ত দানের উপকারিতা ও অপকারিতা কি জানেন। এই পোস্টে রক্তদানের ১০টি উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পারবেন। আমরা যে খাদ্য খাই বা যে পুষ্টি পাই তা আমাদের দেহে সকল অঙ্গে পৌঁছে দেয় এই রক্ত। রক্ত দেওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানা অবশ্যই দরকার।
রক্তের উপাদান, কাজ, উপকারিতা ও অপকারিতা, কে রক্ত দিতে পারবে, রক্ত দিলে কি হয় এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপনি যদি রক্তের সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে চান, তাহলে আমাদের এই পোস্টটি সম্পন্ন মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
রক্তের উপাদান ও কাজ
রক্ত প্রধানত দেহে অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ পরিবাহিত করে। এটি সামান্য লবণাক্ত, ক্ষারধর্মী ও লাল বর্ণের ঘন তরল পদার্থ যা হৃৎপিণ্ড, ধমনী শিরা ও কৈশিক জালিকার মধ্য দিয়ে নিয়মিত প্রবাহিত হয়।
প্লাজমা / রক্তরসঃ রক্তের হালকা হলুদ বর্ণের তরল অংশকে প্লাজমা বলে। মানুষের রক্তের তরলের প্রায় ৫৫% প্লাজমা বা রক্তরস। রক্ত রসের প্রায় ৯০% পানি, বাকি ১০% বিভিন্ন রকমের জৈব এবং অজৈব পদার্থ থাকে। যেমনঃ
- গ্লুকোজ
- চর্বি
- হরমোন
- প্রোটিন
- খনিজ লবণ
- ভিটামিন
- রক্তের তরলতা ঠিক রাখে।
- রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় উপাদান গুলো পরিবহন করা।
- রক্তের অম্ল ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করা।
- রক্তনালিকা সহ রক্তরসে দ্রবীভূত খাদ্য দেহের বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত করা।
- টিস্যু থেকে বর্জ্য পদার্থ নির্গত করা এবং সেগুলো রেচনের জন্য বিক্কে পরিবহন করা।
- শ্বসনের ফলে কোষের সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড কে বাই-কার্বনেট হিসেবে ফুসফুসে পরিবহন করা।
- হরমোন, এনজাইম, লিপিড ইত্যাদি দেহের বিভিন্ন অংশে বহন করা।
- খুবই অল্প পরিমানে অক্সিজেন বাহিত হয়।
- যকৃত, পেশি ইত্যাদি অঙ্গে যে তাপ শক্তি উৎপন্ন হয় সে তাপ শক্তিকে সমগ্র দেহে পরিবহন করে দেহের তাপের সমতা রক্ষা করে।
রক্তকণিকাঃ রক্তে ভাসমান বিভিন্ন কোষ কে রক্তকণিকা বলা হয়। এই ভাসমান কোষগুলো হিমাটোপয়েসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। অন্যান্য কোষের মত স্ব-বিভাজিত হয়ে সৃষ্টি হতে পারে না, এজন্য এদের কোষ না বলে কণিকা বলা হয়ে থাকে। রক্তের ৪৫% হলো রক্তকণিকা। রক্তকণিকা প্রধানত তিন প্রকার। যথা-
লোহিত রক্ত কণিকাঃ লাল অস্থিমজ্জায় লোহিত রক্তকণিকা সৃষ্টি হয়। মানুষের লোহিত রক্ত কণিকায় নিউক্লিয়াস থাকে না এবং এটি দেখতে অনেকটা দ্বি অবতল বৃত্তের মতো হয়। লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিন নামক একপ্রকার রঞ্জক পদার্থ থাকে।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির রক্তের লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা প্রতি কিউবিক মিলিমিটারের প্রায় ৫০ লক্ষ যা শ্বেত রক্ত কণিকার চেয়ে ৫০০ গুণ বেশি। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের রক্তের লোহিত রক্তকণিকা কম থাকে। তবে শিশুদের দেহে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ বেশি থাকে। আমাদের জীবনে প্রতিমুহূর্তে লোহিত রক্ত কণিকা ধ্বংস হয় আবার সমপরিমাণে তৈরিও হয়।
রাসায়নিকভাবে এদের ৬০-৭০% পানি এবং ৩০-৪০% কঠিন পদার্থ থাকে কঠিন পদার্থের মধ্যে প্রায় ৯০% হিমোগ্লোবিন। লোহিত রক্তকণিকার আয়ু কাল সাধারণত ১২০ দিন বা ৪ মাস।
- দেহের প্রতিটি কোষের অক্সিজেন সরবরাহ করা।
- লোহিত রক্ত কণিকা, রক্তের ঘনত্ব ও আঠালো ভাব রক্ষা করে।
- রক্তের আয়নিক ভারসাম্যতা ঠিক রাখে।
- নিষ্কাশনের জন্য কিছু পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে টিস্যু থেকে ফুসফুসে বহন করে।
- হিমোগ্লোবিনের সাহায্য রক্তের অম্ল-ক্ষারের সমতা বজায় রাখার জন্য বাফার হিসেবে কাজ করে।
শ্বেত রক্ত কণিকাঃ শ্বেত রক্তকণিকার নির্দিষ্ট কোন আকার নেই। এগুলো হিউমোগ্লোবিন বিহীন এবং নিউক্লিয়াস যুক্ত বড় আকারের কোষ। লোহিত রক্ত কণিকার তুলনায় শ্বেত রক্তকণিকা অনেক কম। এরা অ্যামিবার মত দেহের আকার পরিবর্তন করে। দেহ, বাইরের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে দ্রুত শ্বেত কণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে।
হিমোগ্লোবিন না থাকার কারণে এদেরকে শ্বেত রক্তকণিকা বলা হয়। এর গড় আয়ু ১ থেকে ১৫ দিন। মানব দেহের প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে ৪ থেকে ১০ হাজার শ্বেত রক্তকণিকা থাকে। আর অসুস্থ দেহের সংখ্যা বেড়ে যায়।
- ইওসিনোফিল রক্তে প্রবেশকৃত কৃত্রিম লার্ভা এবং আ্যলার্জিক- অ্যান্টি ধ্বংস করে।
- নিউট্রোফিলের বিষাক্ত দানা জীবাণু ধ্বংস করে।
- বেসোফিল হেপারিন সৃষ্টি করে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- মনোসাইট ও নিউট্রোফিল ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ভক্ষণ করে।
- দানাদার লিউকোসাইট হিস্টামিন সৃষ্টি করে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
অণুচক্রিকাঃ অণুচক্রিকা হলো সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণিকা। এর আকার সাধারণত গোলাকার, ডিম্বাকার বা রডের মতো হয়ে থাকে। কিন্তু এটিতে কোন নিউক্লিয়াস থাকে না। এতে প্রচুর পরিমাণে সেফালিন নামক ফসফোলিপিড থাকে। এরা ক্ষতস্থানে রক্ত তঞ্চন ঘটায় এবং হিমোস্টেটিক প্লাগ গঠন করে রক্তকে দ্রুত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে। এদের গড় আয়ু কাল প্রায় ১৫ থেকে ১০ দিন। অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে স্বাভাবিকভাবে সময় নেয় ৪ থেকে ৫ মিনিট।
- রক্ত জমাট বাঁধাকে ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন ক্লটিং ফ্যাক্টর রক্ষন করে।
- প্রয়োজন শেষে রক্ত জমাট বিগলনে সাহায্য করে থাকে।
- অস্থায়ী Platelet plug সৃষ্টির মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ করে দেয়।
- রক্ত বাহিকার যে এন্ডোথেলিয়াম রয়েছে তার অন্তঃপ্রাচীরের সুরক্ষার জন্য গ্রোথ-ফ্যাক্টর লক্ষণ করে থাকে।
- ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসকে ধ্বংস করে দেয়।
রক্তের প্রধান কাজ কি
- রক্ত পুরো শরীরে পানি ও তাপের সমতা রক্ষা করে।
- রক্ত রসের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড, ইউরিয়া, হজমকৃত খাদ্যবস্তু, হরমোন ইত্যাদি দেহের বিভিন্ন অংশে পরিবাহিত হয়।
- দেহের কোন স্থানে কেটে গেলে রক্তের অনুচক্রিকা সে স্থানে রক্ত জমাট বাঁধায়।
- লোহিত রক্ত কণিকা হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে ফুসফুস থেকে কষে কষে অক্সিজেন পরিবহন করে।
- শ্বেত রক্তকণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় রোগ জীবাণু ধ্বংস করে দেহেতে সুস্থ রাখে।
- রেচন পদার্থের অপসারণ দেহের বিভিন্ন কলাকোষে উৎপন্ন রেচন পদার্থ সমূহ রক্তের মাধ্যমে রেচন অঙ্গে পৌঁছায়।
- রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
- পুষ্টিদব্যের পরিবহন পরিপাকের ফলে উদ্ভত সরল খাদ্য উপাদান ভিটামিন, খনিজ লবণ অন্ত্র থেকে শোষিত হয়ে রক্তের মাধ্যমে বিভিন্ন কলাকোষে পৌঁছায়।
রক্ত দেওয়ার ১০টি উপকারিতা
কখনো ভেবে দেখেছেন কি, আপনার দান করা রক্ত একজন মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। স্বেচ্ছায় নিজের রক্ত অন্য কারো প্রয়োজন দান করায় রক্তদান। প্রতি ৩ মাস অন্তর প্রত্যক সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে রক্ত দান করতে পারেন। এতে স্বাস্থ্যের কোন ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। রক্তদানের ১০ টি উপকারিতা-
- রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। রক্ত দান করার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার শরীরের মধ্যে অবস্থিত 'বোন ম্যারো' নতুন কণিকা তৈরি জন্য উদ্দীপ্ত হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।
- বছরে তিনবার রক্তদান শরীরের রোহিত রক্তকণিকা গুলোর প্রানবন্ততা বাড়িয়ে তোলে ও নতুন কণিকা তৈরীর হার বাড়ায়।
- নিয়মিত রক্তদানকারীর হার্ট ও লিভার ভালো থাকে।
- ইংল্যান্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রক্তদান ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
- স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে পাঁচটি পরীক্ষা ( হেপাটাইসিস-বি, হেপাটাইসি-সি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি ) সম্পূর্ণ বিনা খরচে করা যায়। এর মাধ্যমে জানা যায় শরীরে অন্য বড় কোন রোগ আছে কিনা।
- নিয়মিত রক্তদান রক্তের কোলেস্টেরলের উপস্থিতি কমাতে সাহায্য করে।
- শরীরে অতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতিকে বলে Hemochromatosis । নিয়মিত রক্তদান করলে এই রোগ প্রতিরোধ হয়।
- স্থূল দেহে মানুষের ওজন কমাতে রক্তদান সহায়ক।
- রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত পুণ্যের কাজ।
- মুমূর্ষকে স্বেচ্ছায় রক্ত দান করলে মানসিক শান্তি মিলে।
রক্ত দানের অপকারিতা
অনেকে এখন প্রশ্ন করতে পারে রক্ত দেওয়ার অপকারিতা কি। রক্ত দেওয়ার উপকারিতা তো জানলাম। রক্ত দান করলে আপনার শারীরিক কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু আপনার বয়স ১৮ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে হতে হবে। আপনার ওজন কমপক্ষে ৪৫ কেজি হতে হবে। এছাড়াও আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে ও রক্ত দেওয়ার জন্য উপযোগী হতে হবে।
আমরা জানি রক্তদানের সময় কিছু পরীক্ষা করে। সেই পরীক্ষায় যদি আপনার শরীরে কোন বড় রোগ ধরা পড়ে, তাহলে আপনি ভয় না পেয়ে সে রোগের চিকিৎসা করাই নিবে। আর মূল কথা রক্তদান করলে কোন রকম ক্ষতি হয় না।
রক্ত দানের যোগ্যতা
আমরা অনেকে আছি রক্ত দান করার জন্য আগ্রহী, আবার অনেকেই আছে রক্ত দিতে চাই না। মনে করে রক্ত দিলে শরীরের ক্ষতি হয়। আসলে যারা রক্ত দেওয়ার যোগ্যতা রাখে না, তারা যদি রক্ত দেয় তাহলে শারীরিকভাবে একটু অসুস্থ হয়ে পড়ে। এজন্য রক্তদানের যোগ্যতা সম্পর্কে জানা দরকার।
- রক্তদানকারীর বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে।
- রক্তদানকারী একজন পুরুষের ওজন হতে হবে অন্তত ৪৮ কেজি এবং নারীর অন্তত ৪৫ কেজি।
- রক্ত দানের সময় রক্তদাতার তাপমাত্রা ৯৯.৫ ফারেনহাইটের নিচে এবং নাড়ির প্রতি ৭০ থেকে ৯০ এর মধ্যে হতে হবে।
- রক্তদানকারীর রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকতে হবে।
- পুরুষের ক্ষেত্রে রক্তের হিমোগ্লোবিন প্রতি ডেসি-লিটারে ১৫ গ্রাম এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১৪ গ্রাম ওহা দরকার।
- রক্তদাতা কে অবশ্যই ভাইরাসজনিত রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও চর্মরোগ মুক্ত থাকতে হবে।
- সাধারণত একজন রক্তদাতা ৩ মাস পরপর রক্তদান করতে পারবেন।
রক্ত দানের পর করনীয়
রক্ত নেওয়ার পর কি কি সমস্যা হতে পারে
- যাদের কিছুদিন পরপর রক্ত নিতে হয়, তাদের দেহে লৌহের আধিক্য সহ অন্যান্য সমস্যা হতে পারে।
- অনেক সময় অধিক রক্ত দ্রুত প্রবেশ করলে, বৃদ্ধ অথবা হৃদরোগীর হার্ট ফেলিওর জাতীয় সমস্যা হতে পারে।
- রক্ত গ্রহণ করার ফলে অনেক সময় কাঁপুনি, জ্বর আসা এবং এলার্জি জাতীয় ছোটখাটো সমস্যা হতে পারে।
- ভুলক্রমে এক গ্রুপের রক্ত অন্য গ্রুপের রোগীদের দিলে রক্ত হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতিক। এ ধরনের ঘটনা কম হলো একেবারেই হয় না, তা কিন্তু না।
- যদি কখনো ভুলক্রমে মেয়াদ উত্তীর্ণ রক্ত বা ভেজাল রক্ত নেওয়া হয় তাহলে রোগীর শরীরের মারাত্মক সমস্যা হয়ে যাবে।
SM TECHY এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url