যিকির কত প্রকার - যিকিরের গুরুত্ব ও ফজিলত
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার ইবাদত করার জন্য। তিনি সমস্ত জিন এবং মাখলুকাতকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তার ইবাদত করার জন্য। ইবাদতের মধ্যে একটি উত্তম ইবাদত হল আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকা। জিকির করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা যায় এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে গণ্য হওয়া যায়।
আমরা তো অনেকে নানা রকম ভাবে যিকির করে থাকি, কিন্তু আমরা কয়জনই বা জানি যিকির কত প্রকার বা যিকিরের গুরুত্ব ও ফজিলত কি সে সম্পর্কে আমরা সঠিকভাবে জানি না। আমি আজকে আপনাদেরকে এই বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে জানাবো। এ বিষয়গুলি সম্পর্কে জানতে এই পোস্টটি সম্পন্ন মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
পোস্ট সূচিপত্র
যিকির কত প্রকার
আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম পন্থার মাঝে একটি হলো জিকির করা। যিকর প্রথমত দুই প্রকার।
1. আল্লাহ তাআলার সুন্দরতম নামাবলী এবং মহত্তম গুণাবলীর যিকর করা, এসব দ্বারা তার প্রশংসা ও গুণগান করা এবং আল্লাহর জন্য যা উপযুক্ত নয় তা থেকে তাকে পাক ও পবিত্র মনে করা। এই যিকরও আবার দুই প্রকারের-
ক - আল্লাহর নাম ও গুণাবলী দ্বারা তার প্রশংসা রচনা করা। যেমন “সুবহা-নাল্লা-হ’, ‘আলহামদু লিল্লা-হ’, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’, ‘আল্লাহু আকবার’ প্রভৃতি।
খ- আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর অর্থ ও আহকাম উল্লেখ করা। যেমন বলা যে, আল্লাহ তাআলা বান্দার সমস্ত শব্দ শুনেন, সকল স্পন্দন দেখেন তাঁর নিকট কোন কর্মই গুপ্ত থাকে না, বান্দার মাতা-পিতা অপেক্ষা তিনিই বান্দার উপর অধিক দয়াশীল। তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান--ইত্যাদি।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে সতর্কতার বিষয় এই যে, যিকরকারী যেন সেই নাম ও গুণের কথাই উল্লেখ করে, যার দ্বারা আল্লাহ পাক নিজের প্রশংসা করেছেন অথবা তার রসূল যার দ্বারা তাঁর গুণগান করেছেন। এতে যেন কোন প্রকারের হেরফের ও দৃষ্টান্ত বা উপমা বর্ণনা না করা হয় এবং গুণের দলীলকে নিরর্থক বা আল্লাহকে ঐ গুণহীন মনে না করা হয়। যেমন ঐ সকল নাম ও সিফাতের কোন দুর-ব্যাখ্যা করাও বৈধ নয়।
পক্ষান্তরে এই যিকর আবার তিন প্রকারের; হাদ, সানা এবং মাজদ। সন্তোষ ও ভক্তির সাথে আল্লাহর সিফাতে-কামাল উল্লেখ করে প্রশংসা করাকে হামদ’ বলা হয়। গুণের পর আরো গুণগ্রামের উল্লেখ করে প্রশংসা করাকে ‘সানা’ বলা হয়। এবং আল্লাহ তাআলার মাহাত্ম ও শান-শওকত এবং মহিমা ও সার্বভৌমত্বের গুণাবলী দ্বারা প্রশংসা করাকে ‘মাজদ’ বলা হয়। এই তিন প্রকার প্রশংসা সূরা ফাতিহার প্রারম্ভে একত্রিত হয়েছে।
অতএব বান্দা যখন নামাযে বলে (الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ) অর্থাৎ, সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর নিমিত্তে তখন আল্লাহ বলেন, 'বান্দা আমার প্রশংসা করল। যখন বলে, (الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ) অর্থাৎ যিনি অনন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু’ তখন আল্লাহ বলেন, 'বান্দা আমার স্তুতি বর্ণনা করল।
আর বান্দা যখন বলে, (مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ) অর্থাৎ বিচার দিনের অধিপতি’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, বান্দা আমার গৌরব বর্ণনা করল।' (মুঃ ৩৯৫)।
2. আল্লাহর আদেশ, নিষেধ এবং বিভিন্ন অনুশাসনের যিকর (স্মরণ) করা। এটিও দুই রকম-
ক - আল্লাহর বিধান উল্লেখ ও জ্ঞাপন করে তাঁর স্মরণ করা। যেমন বলা যে, আল্লাহ এই করতে আদেশ করেছেন, অমুক করতে নিষেধ করেছেন, তিনি এই কাজে সন্তুষ্ট, ঐ কাজে রাগান্বিত ইত্যাদি।
খ - তার বিধান ও অনুশাসন পালন করে তার যিকর (স্মরণ করা, যেমন, যে কাজ তিনি আদেশ করেছেন সত্বর তা পালন করে তাঁর যিকর করা, যা নিষেধ করেছেন সত্বর তা বর্জন করে তার স্মরণ করা। এই সকল যিকর যদি যিকরকারীর নিকট একত্রিত হয়, তবে তার যিক শ্রেষ্ঠতম যিকর। যিকরের আরো এক প্রকার যিকর, আল্লাহ পাকের দেওয়া সম্পদ, দান অনুগ্রহ, সাহায্য ইত্যাদির স্থান ও কাল প্রভৃতি উল্লেখ করে যিকর (শুকর) করা। এটাও এক উত্তম যিকর।
সুতরাং উক্ত পাঁচ প্রকার যিকর, যা কখনো অন্তর ও রসনা দ্বারা হয় এবং এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ যিক। আবার কখনো কেবল অন্তর দ্বারা হয়, যা দ্বিতীয় পর্যায়ের এবং কখনো বা কেবল রসনা দ্বারা হয়, যা তৃতীয় পর্যায়ের।
2 নং যিকর হলে অন্যান্য অঙ্গ দ্বারা। কার্যে পরিণত করাও যিকর হয়। অতএব মুমিনের সারা জীবন ও জীবনের প্রতি মুহূর্তটাই যিকরের স্থল। যেমন রসূল (সাঃ)-এর যিকরে আমরা বুঝতে পারব।
উল্লেখ্য যে, দুআ অপেক্ষা যিকর উত্তম। যেহেতু যিকরে আল্লাহ তাআলার সুন্দরতম নাম, মহিমময় গুণ ইত্যাদির সাথে তার প্রশংসা করা হয়। কিন্তু দুআতে বান্দা নিজের প্রয়োজন আল্লাহর নিকট জানিয়ে তার পূরণভিক্ষা করে থাকে।
যে দুইয়ের মাঝে রয়েছে। বিরাট পার্থক্য। আবার যিকর অপেক্ষা কুরআন তেলাঅত উত্তম। কিন্তু যথােপযুক্ত সময়কালে তেলাঅত, যিকর ও দুআ স্ব-স্ব স্থানে শ্রেষ্ঠ। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য আল ওয়াবিলুস সইয়্যেব)।
যিকিরের গুরুত্ব ও ফজিলত
জিকির হলো একটি সর্বোত্তম ইবাদত। জিকির শব্দের অর্থ হচ্ছে স্মরণ করা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা; অর্থাৎ নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা, তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর ইসমে জাত ও ইসমে সিফাত মুখে কিংবা মনে উচ্চারণ করা।
আল্লাহ তায়ালা জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি জিন ও ইনসানকে আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি’।
হজরত আবু দারদা রা: সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: সাহাবায়ে কেরামদের সম্বোধন করে ইরশাদ করেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন বস্তুর সংবাদ দেবো না যা তোমাদের যাবতীয় আমলের চেয়ে উত্তম, তোমাদের প্রভুর কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, তোমাদের মর্যাদা বিশেষভাবে বর্ধনকারী।
সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, সেটি কি বস্তু? রাসূল সা: ইরশাদ করলেন, ‘সেটি হলো আল্লাহর জিকির’। সব ইবাদতের রূহ হচ্ছে আল্লাহর জিকির। আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের সর্বাবস্থায় অধিকহারে তাঁর জিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করো।
জিকির এমন একটি ইবাদত যার কোনো সময়, সীমা, পরিমাণ ও শর্ত নেই। দিনে-রাতে, সকাল-সন্ধ্যায়, হাঁটতে-বসতে এমনকি শয়ন অবস্থায় এবং অজু অবস্থায় হোক কিংবা অজুবিহীন হোক, সর্বাবস্থায় জিকির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জিকিরের উপকারিতা এত বেশি ও ব্যাপক যে, এর মাধ্যমে পার্থিব কার্যক্রমও ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়।
জিকির থেকে গাফেল হলে সৃষ্টির ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নানা বিপদাপদ নাজিল হয়ে থাকে। যারা জিকির থেকে গাফেল হয় তাদের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে এবং যে আল্লাহর জিকির করে না তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতদের মতো।’ (বুখারি-৬৪০৭, মুসলিম-৭৭৯)
জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার যোগসূত্র তৈরি হয়। বান্দা আল্লাহর দয়া ও মাগফিরাত লাভের যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। জিকিরের আরো বেশ কিছু ফজিলত রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে-
- যিকিরের মাধ্যমে জিহবাকে বাজে কথা, গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা প্রভৃতি হারাম ও অপছন্দনীয় বিষয় হতে রক্ষা করা যায়।
- যিকিরের মাধ্যমে অন্তরের দুঃখ-বেচনা ও দুঃশ্চিন্তা দূর হয়। খুশি ও আনন্দ লাভ করা যায়। অন্তর জীবিত থাকে, তাতে শক্তি ও পরিছন্নতা সৃষ্টি হয়।
- যিকির হচ্ছে সবচাইতে সহজ ইবাদত। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। যিকিরের মাধ্যমে জান্নাতে বৃক্ষরোপণ করা হয়।
- যিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত (দয়া) নাযিল আবশ্যক হয়, ফেরেশতারা তার জন্য দুয়া করে। যিকিরকারীদেরকে নিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করেন।
- অধিকহারে আল্লাহর যিকিরকারী সর্বশ্রেষ্ঠ আমলকারীদের অন্তর্ভুক্ত। যেমন সর্বোত্তম রোযাদার হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে রোযা অবস্থায় বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করে।
- যিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করা যায়। তাঁর নিকটবর্তী হওয়া যায়। তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়া যায়। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুভব করা যায়। তাঁকে ভয় করা যায়। তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তন করা যায়। তাঁর আনুগত্য করতে সাহায্য পাওয়া যায়।
- অন্তরের মধ্যে যে শূণ্যতা ও অভাব থাকে তা আল্লাহর যিকির ছাড়া দূর হবেনা। এমনিভাবে অন্তরের মধ্যে যে কঠোরতা আছে আল্লাহর যিকির ছাড়া তা নরম হবেনা।
- বান্দা যখন যিকিরের মাধ্যমে সুখের সময় আল্লাহকে স্মরণে রাখবে তিনিও বান্দাকে তার দুঃখের সময় স্মরণ করবেন। বিশেষ করে মৃত্যুর সময়, মৃত্যু যন্ত্রনার সময়।
পিতা মাতার জন্য দোয়া
رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
উচ্চারণ : ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’অর্থ : (হে আমাদের) পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া কর; যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪)
رَبَّنَا ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ ,يَقُومُ ٱلْحِسَابُ
উচ্চারণ : ‘রাব্বানাগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিলমুমিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।’ অর্থ : ‘হে আমাদের রব! যেদিন হিসাব কায়েম হবে, সেদিন আপনি আমাকে, আমার বাবা-মাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪১)
رَّبِّ ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيْتِىَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَٰتِ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّٰلِمِينَ إِلَّا تَبَارًۢا
উচ্চারণঃ ‘রাব্বিগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিমান দাখালা বাইতিয়া মুমিনাও ওয়া লিলমুমিনিনা ওয়াল মুমিনাত ওয়া লা তাযিদিজ জ্বালিমিনা ইল্লা তাবারা।’ অর্থ : ‘হে আমার রব! আমাকে, আমার বাবা-মাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন আর আপনি জালিমদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না।’ (সুরা নুহ : আয়াত ২৮)
SM TECHY এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url