মাথা যন্ত্রণা কমানোর ঘরোয়া উপায় - মাথা যন্ত্রণা কেন হয়
জীবনে কখনো মাথাব্যথায় ভোগেনি এমন লোক হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই মাথা যন্ত্রণা কেন হয়। বিভিন্ন কারণে মাথা যন্ত্রণা হয়। মাথা যন্ত্রণা কমানোর ঘরোয়া উপায় জানা অনেক দরকার। মাথাব্যথা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ওষুধ সেবন করে। তবে ওষুধ সেবন না করে, মাথা যন্ত্রণা কমানোর ঘরোয়া উপায় ফলো করে মাথা যন্ত্রণা কমানো যায়।
মাথা যন্ত্রণা কেন হয়
ব্রেইন ও হাড়ের আবরণ তার চারপাশের রক্তনালি, নার্ভ তাদের আবরণ, মাথার চামড়ার নিচের মাংসপেশি, চোখ, সাইনাস, কান ও ঘাড়ের মাংসপেশির ইত্যাদির প্রদাহ এবং টানই মূলত মাথাব্যথার প্রধান কারণ।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রায় দেড়শ প্রকারের মাথাব্যথা রয়েছে। প্রতিটি মাথাব্যথার আলাদা আলাদা সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে মাথাব্যথা মানেই হাইপ্রেশার বা ব্রেইনের ক্যানসার। আসলে সেটা সত্য নয়। হাইপ্রেশারের মাথা জাতীয় কোনো লক্ষণ সাধারণত পাওয়া যায় না। এজন্য হাইপ্রেশারকে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার। আর ব্রেইনের নিজস্ব কোনো পেইন ফাইবার নেই। তাই ব্রেইন তার নিজের ব্যথা নিজে বুঝতে পারে না।
টেনশন টাইপ হেডেকঃ সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার নাম হলো টেনশন টাইপ হেডেক। টেনশন টাইপ হেডেক এটি সারা মাথাজুড়ে হয় এবং খুব একটা তীব্র না হলেও সারাক্ষণ থাকে। চলাফেরায় এ ব্যথা বাড়ে না। তবে সকালের দিকে এই ব্যথা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্রতা বাড়তে থাকে।
সেক্সুয়েল হেডেকঃ স্বামী-স্ত্রীর মিলনের সময় বা আগে ও পরে মাথাব্যথা হতে পারে। এর নাম সেক্সুয়াল হেডেক। সাধারণত প্রচণ্ড এক্সারশনে এ ব্রেইনে রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে এ ধরনের ব্যথা হয়। এ ব্যথা খুব একটা তীব্র হয় না এবং সেরে যায় কিছুক্ষণের মধ্যে।
ক্লাস্টার হেডেকঃ সাধারণত চোখ বরাবর এ ব্যথা হয়। একটা নির্দিষ্ট সময় হয়, এবং দিনে কয়েকবার হয়। ক্লাস্টার হেডেক এ চোখ লাল হয়, চোখ দিয়ে পানি পড়ে, চোখের দৃষ্টিতেও সামান্য ব্যঘাত হয়। দিনে রাতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর হয়, নির্দিষ্ট সময় নিয়ে থাকে তাই একে ক্লাস্টার হেডেক বলে।
ক্রনিক ডেইলি হেডেকঃ মেয়েদের শরীরের হরমোনের তারতম্যের জন্যে প্রায়ই মাথাব্যথা হয়। একে হরমোনাল হেডেক বলে। সাধারণত মাসিকের সময় বা আগে পরে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যায় বলে এই ব্যথা হয়। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় ও হরমোনের তারতম্যের জন্যে মাথাব্যথা হয়। মাসের প্রতিদিনই চিন চিন করে মাথাব্যথা হওয়াকে ক্রনিক ডেইলি হেডেক বলে।
সাইনাসঃ নাকের দু’পাশের হাড়ে ও কপালের হাড়ের ভেতর ছোট ছোট কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে। এগুলোকে সাইনাস বলে। এতে বাতাস থাকে এবং এই বাতাস ব্রেইনের ভারের সাম্যতা রাখে। হাড়ের ভেতর এসব সাইনাসের আবরণে প্রদাহ হলে বাতাস ও সর্দি জমে থাকে। এর ফলে সাইনাসগুলো বরাবর তীব্র ব্যথা হয়। এটাই সাইনুসাইটিস ব্যথা নামে সাইনাস হেডেক নামে পরিচিত। এ ব্যথার সঙ্গে সর্দি হাঁচি কাশি থাকে।
মাইগ্রেনঃ নারীরাই মাইগ্রেনে বেশি ভোগেন। সাধারণত ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়স থেকে মাইগ্রেনের লক্ষণ দেখা দেয়। স্থায়ী হয় ৪২ থেকে ৫২ বছর বয়স পর্যন্ত। মাথার যেকোনো একপাশে ব্যথা হয়। একবার একপাশে ব্যথা হলে পরের বার অন্য পাশেও ব্যথা হতে পারে। চার ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যথা স্থায়ী হতে পারে। ব্যথা শুরুর আগে চোখের সামনে আলোর নাচানাচি, আঁকাবাঁকা লাইন ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
মাথা ব্যাথা কোন রোগের লক্ষণ
বর্তমান সময়ে আমরা প্রায় সকলেই মাথা ব্যথার সমস্যা নিয়ে ভুগি। এই সমস্যা থেকে আমাদের আরো অনেক বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যেতে পারে, সে ব্যাপারে আমাদের কোন ধারণা নেই। আমরা মাথা ব্যাথাকে তুচ্ছ মনে করি। আসলে মাথাব্যথা একটি মারাত্মক সমস্যা এর থেকে হয়ে যেতে পারে অনেক বড় ধরনের সমস্যা।
মাথাব্যথা সাধারণত দুই ধরনের হয়, যেমন- ১. প্রাথমিক মাথাব্যথা, ২. সেকেন্ডারি মাথাব্যথা। প্রাথমিক মাথা ব্যাথা সেরকম জটিল না হলেও, সেকেন্ডারি মাথাব্যথা থেকে হতে পারে অনেক জটিল সমস্যা। তাই আমাদের জেনে রাখা উচিত মাথাব্যথা কোন রোগের লক্ষণ হিসাবে প্রকাশ পেতে পারে। আর মাথাব্যথা কোন রোগের লক্ষণ এ বিষয়ে জানা থাকলে আমরা সময় মত ব্যবস্থা নিতে পারব।
- উচ্চ রক্তচাপ
- ডায়াবেটিস
- ব্রেন টিউমার
- মস্তিষ্কের প্রদাহ
- সাইনোসাইটিস
- স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা
- মাইগ্রেন
- মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ
- হার্টের সমস্যা
যদি কখনো তীব্র মাথাব্যথা হয় সাথে বমি ভাব, জ্বর, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, শরীরে চুলকানি হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ প্রকাশ পায়, তাহলে অবশ্যই এ ধরনের মাথাব্যথা কেউ অবহেলা না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ মাথাব্যথার সাথে যদি এই ধরনের উপসর্গগুলো প্রকাশ পায়, তাহলে তা জটিল কোন রোগের লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।
মাথার পিছনে ব্যথা হলে করণীয়
স্ট্রেস, ঘুমের সমস্যা, হরমোনের উঠানামা, ধুমপান, খাবার বাদ দেয়া, তীব্র গন্ধ, চুল বাঁধার ধরণ এবং অত্যধিক আলো মাথাব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। মাথা ব্যথা মারাত্মক কোন স্বাস্থ্যসমস্যার পূর্বলক্ষণও হতে পারে। মাথাব্যথা দেখা দিলে আমরা অনেকেই পেইনকিলার খেয়ে বা ঘুমিয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করি।
ঘাড়ে আঘাত পেলেও মাথার পেছনের দিকে ব্যথা হতে পারে। এই ধরণের ব্যথা মাথার একপাশে শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে মাথার পেছনের দিকে কানের কাছাকাছি পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে।
টেম্পোরাল আরটারাইটিস- ৫০ বছরের বেশি বয়সের মানুষের হয়ে থাকে এই ধরণের মাথাব্যথা। মাথায় রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্থ হলে ও প্রদাহ হলে টেম্পোরাল আরটারাইটিস হয়। এ ধরণের মাথাব্যথায় মাথার একপাশে কম্পন হতে পারে এবং মাথার তালুতে ছড়িয়ে পরে ব্যথা। ঘাড়ের উপরের দিকে মেরুদন্ডের ধমনীর ব্যাবচ্ছেদ করা হলে এরকম ব্যথা হতে পারে।
নিচে আমরা মাথা যন্ত্রণা কমানোর ঘরোয়া উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপনি সেই একই পন্থা অবলম্বন করে মাথার পেছনের ব্যথা দূর করতে পারেন। আপনি যদি নিচের পয়েন্টটি মনোযোগ সহকারে পড়েন তাহলে আপনি মাথার পিছনে ব্যথাও দূর করতে পারবেন।
মাথা যন্ত্রণা কমানোর ঘরোয়া উপায়
মাথা ব্যাথা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ওষুধ সেবন করেন। তবে ওষুধ সেবনের আগে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি রয়েছে, সেগুলো অবলম্বন করলে মাথাব্যথা থেকে অনেকটা মুক্তি পাওয়া যায়। আসুন আমরা মাথার যন্ত্রণা কমানোর ঘরোয়া উপায় গুলো বিস্তারিতভাবে জেনে নেই-
- আলো কমানঃ মাথা যন্ত্রণা শুরু হলে ঘরের আলো কমিয়ে দিন। কম্পিউটার স্ক্রিন, ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকুন। বাইরে থাকলে ভাল মানের সানগ্লাস ব্যবহার করুন।
- চা ও কফিঃ চা ও কফিতে যে ক্যাফেইন থাকে তা মাথা যন্ত্রণা কমাতে বেশ কার্যকারী। চায়ের সঙ্গে আদা-লবঙ্গ-মধু মিশিয়ে খেলে মাথা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- এসেনশিয়াল অয়েলঃ আঙুলের ডগায় এসেনশিয়াল অয়েল লাগিয়ে কপালে আর রগে ম্যাসাজ করুন। ল্যাভেন্ডার বা পিপারমিন্টের মতো কোনো সুগন্ধি ফ্লেভারের তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে মাথা যন্ত্রণা অনেকটা কমে।
- ম্যাসাজঃ কপালের দুই পাশের রগ বা ঘাড়ের কাছে যদি কিছু সময়ের জন্য আঙুলের ডগা দিয়ে ম্যাসাজ করা যেতে পারে। ক্লান্তির কারণে মাথা ধরলে এই ম্যাসাজ খুব কাজে দেয়। আঙুলের ডগার চাপ ব্যথার উৎপত্তিস্থলে গিয়ে কাজ করে।
- গোসলঃ অসহ্যকর মাথা ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে গোসল করতে পারেন। মাথায় কিছুক্ষণ ঠান্ডা পানি ঢাললে ভালো অনুভূতি হবে।
- আদাঃ আদা মাথার রক্তনালির প্রদাহ কমাতে সাহায্য করবে। এতে মাথা ব্যথা কমবে। আদার রস ও লেবুর রস মিশিয়ে খান। মাথা ব্যথা থাকলে দিনে দুই থেকে তিনবার এটি খেতে পারেন। এ ছাড়া ম্যথা ব্যথা দূর করতে দুই টুকরো আদার ক্যান্ডিও চিবুতে পারেন।
- বরফঃ বরফ মাথা যন্ত্রণা দূর করতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি এটি ব্যথা উপশম করবে। বরফ দ্বারা মাইগ্রেনের ব্যথা ও উপশম করা যায়। ভালো তোয়ালের মধ্যে কয়েক টুকরো বরফ নিয়ে মাথার মধ্যে কিছুক্ষণ ধরে থাকুন। তবে যাদের ঠান্ডা লাগার সমস্যা আছে তাদের এটা না করাই ভালো।
মাথা ব্যথার দোয়া
মাথা ব্যথা প্রায় সব ধরনের মানুষের হয়। মাথাব্যথা অনেক যন্ত্রণাদায়ক রোগ। মাথা ব্যাথার কারণে মানুষ স্থির হয়ে থাকতে পারেন না। সুস্থ সুন্দর ও আরামদায়ক জীবন যাপনের জন্য মাথাব্যথা সহ অন্যান্য সকল রোগ থেকে সুস্থ থাকা অত্যন্ত জরুরী। মাথাব্যথা যেমন হয় তেমনি এর থেকে বাঁচার জন্য কিছু আমল ও দোয়া রয়েছে, যা বাস্তবায়ন করলে মাথাব্যথা থেকে আরাম পাওয়া যায়-
কুরআনুল কারীমে মাথাব্যথা দূর করার জন্য একটি আয়াত রয়েছে-
বাংলা উচ্চারণ- লা ইউসাদ্দাউনা আনহা ওয়া লা ইয়ুংযিফুন।’ (সুরা ওয়াকিয়া : আয়াত ১৯)
মাথাব্যথা দূর করার জন্য আরও একটি দোয়া- বাংলা উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহিশ শাফি, বিসমিল্লাহি কাফি; আল্লাহুম্মাশ ফিনি ওয়াফিনি ওয়া‘ফু আন্নি।
মাথাব্যথা নিয়ে হাদিসের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে- উসমান ইবনে আবিল আস (রা.)-হতে বর্ণিত, তিনি রাসুল (সা.)-কে জানিয়েছিলেন যে, যখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তখন থেকে তিনি তার শরীরে ব্যথা অনুভব করছেন। " তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে স্থানে তোমার মাথা ব্যথা হচ্ছে, সেখানে হাত রেখে তিনবার বিসমিল্লাহ বলো, সাতবার আউজু বিকুদরাতিহি মিন শাররি মা তুআনি ওয়া তাজিদু ওয়া তুহাজিরু। (শুরুহুল হাদিস, হাদিস : ১৫৮)
পরিশেষে বলা যায় যে মাথাব্যথা স্বাভাবিকভাবে কমবেশি সব মানুষেরই হয়। তো মাথাব্যথা হলে সেটা নিয়ে বসে না থেকে ভালোভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কেননা এই মাথাব্যথায় পরবর্তীতে বড় কোন রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই জন্য মাথা ব্যথা হলে সঙ্গে সঙ্গে তার পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমেই ওষুধ সেবন না করে ঘরোয়া উপায়ে কিভাবে এটি দূর করা যায় সেটি অবলম্বন করুন। আপনি যদি আমাদের এই পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়ে থাকেন তাহলে আপনি অবশ্যই জানতে পারবেন ঘরোয়া উপায় কিভাবে মাথা যন্ত্রণা দূর করা যায়।
SM TECHY এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url