মৃত ব্যক্তির নামে কি কোরবানি দেওয়া যাবে - কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কয়টি
মুসলিমদের বড় উৎসব কোরবানির ঈদ। আর এই কোরবানির ঈদের এই সময় প্রতিটি মুসলিমের মনে এই একবারের জন্য হলেও এই প্রশ্নটি জাগে যে মৃত ব্যক্তির নামে কি কোরবানি দেওয়া যাবে। আমরা কয়জনই বা এই সম্পর্কে সঠিক হাদিস জানি। একজন মুসলিম হিসেবে কোরবানি দেওয়ার পূর্বে অবশ্যই জানা প্রয়োজন যে মৃত ব্যক্তির নামে কি কোরবানি দেওয়া যাবে কিনা।
এছাড়াও কুরবানী করার পূর্বে জানতে হবে কুরবানীর বিধি-বিধান সম্পর্কে আর সেইসাথে জানতে হবে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার সত্য কয়টি বা কি কি। যে ব্যক্তি কোরবানি করবেন তার অবশ্যই জানা প্রয়োজন যে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হয়েছে কিনা। কারণ কোরবানি ওয়াজিব না হলে তো আর কুরবানী কবুল হবে না। এজন্য কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কি সে বিষয়গুলো জানতে হবে।
সূচিপত্রঃ
কুরবানির বিধি-বিধান
কুরবানী করতে হলে কিছু বিধি-বিধান মেনে কোরবানি দিতে হয়। অর্থাৎ কোরবানি ওয়াজিব বার জন্য কিছু সত্য রয়েছে যেগুলো মেনে কোরবানি দিতে হয়। এছাড়াও কোরবানির পশুর ক্ষেত্রেও কিছু বিধি-বিধান রয়েছে যেগুলো মেনে কোরবানি দিতে হয়। এক নজরেই এখান থেকে জেনে নিন কুরবানীর সকল বিধি-বিধান -
- কুরবানির বিধান: সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য কুরবানি দেয়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ (গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত) মতান্তরে ওয়াজিব (আবশ্যক)।
- কুরবানির পশু: উট, গরু, দুম্বা, ছাগল ও ভেড়া-নর ও মাদী।
- যে সকল পশু কুরবানি করা বৈধ নয়: স্পষ্ট কানা,স্পষ্ট অসুস্থ, ল্যাংড়া ও হাড্ডিসার পশু। (তিরমিযি, কিতাবুল হজ/ ৩৪)
- কুরবানির পশুর বয়স কমপক্ষে: উট ৫ বছর, গরু ২ বছর, ছাগল ও দুম্বা ১ বছর ও ভেড়া ৬ মাস।
- কুরবানির সময়-সীমা: ঈদুল আযহার সালাতের পর থেকে শুরু করে ঈদের পরে আরও তিন দিন পর্যন্ত (মোট চার দিন)
- জবাই: সম্ভব হলে নিজ হাতে জবাই করা সুন্নত। তবে অন্যের মাধ্যমে জবাই করা জায়েজ।
- গোস্ত বণ্টন: কুরবানির গোস্ত নিজে খাওয়া, আত্মীয়-প্রতিবেশীকে হাদিয়া দেয়া এবং গরীব মানুষদের দান করা সুন্নত। (তিন ভাগ করা উত্তম; আবশ্যক নয়)।
- গোস্ত সংরক্ষণ: পরবর্তীতে খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানির গোস্ত সংরক্ষণ করা বৈধ।
- কুরবানির চামড়া: ইচ্ছে করলে নিজে ব্যবহার করা যায় আবার তা সদকাও করা যায়। উভয়টাই জায়েজ ইনশাআল্লাহ।
- ভাগে কুরবানি: একটি পশু একটি পরিবারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট। তবে গরু বা উট সাত ভাগে কুরবানি দেয়া জায়েজ।
- মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি: মৃত ব্যক্তি ওসিয়ত করে গেলে অথবা নিজের কুরবানিতে পরিবারের জীবিত ও মৃত সকলকে শামিল করে নিয়ত করা বৈধ। তবে মৃতের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কুরবানি করা সুন্নত নয়।
- কুরবানি দাতার জন্য করণীয়: জিল হজ্জ মাস শুরু হলে কুরবানি করা পর্যন্ত নখ-চুল ইত্যাদি কাটা বৈধ নয়। তবে অনিচ্ছা বা অজ্ঞতা বশত: কাটলে তার জন্য তওবা করতে হবে। এ জন্য আলাদা কোন কাফফারা নাই। পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য এ বিধান প্রযোজ্য নয়।
মৃত ব্যক্তির নামে কি কোরবানি দেওয়া যাবে
মৃত ব্যক্তির নামে পৃথকভাবে কুরবানী দেওয়ার কোন ছহীহ দলীল নেই। আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত হিসাবে তাঁর জন্য পৃথক একটি দুম্বা কুরবানী দিয়েছেন বলে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা অত্যন্ত যঈফ (আহমাদ হা/১২৭৮; আবূদাঊদ হা/২৭৯; মিশকাত হা/১৪৬২)। মূলত কুরবানীর বিধান কেবল জীবিত ব্যক্তির জন্য।
কেউ যদি কুরবানীর পূর্ব মুহূর্তে মারা যায় তাহ’লে তার উপর থেকে বিধান রহিত হয়ে যাবে। অতএব মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা সুন্নাত নয় (উছায়মীন, আহকামুল উযহিয়াহ ১/৩-৪)।
যেহেতু নিজের উপর কোরবানি ওয়াজিব। তাই তার উচিত নিজের নামেই কোরবানি দেওয়া। আর মৃত ব্যক্তিকে সওয়াব পৌঁছানোর নিয়ত করা। এতে করে নিজের কোবানিও আদায় হবে, আবার মৃতকে সওয়াবও পৌঁছানো হবে। এটাই নিরাপদ ও উত্তম পদ্ধতি।
তবে কতিপয় ফিকাহবিদদের মতে, মৃত ব্যক্তির অসিয়ত ছাড়া এমনিতেই তার নামে নফল কোরবানির নিয়তে কোরবানি দিলে, কোরবানিদাতা ব্যক্তির নিজের ওয়াজিব কোরবানিটিও আদায় হয়ে যাবে। তবে প্রথম সুরতটিই অধিকতর নিরাপদ। (মাজমাউল আনহুর : ০২/৫১৬; আল-বাহরুর রায়িক : ০৮/৩১৮।
কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কয়টি
মুসলিমদের দুইটি প্রধান উৎসব হচ্ছে ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর। অর্থাৎ একটি ছোট ঈদ আরেকটি বড় ঈদ, বড় ঈদ কেই মূলত কোরবানির ঈদ বলা হয়। আর কোরবানির ঈদে কোরবানি করতে হলে কিছু শর্ত প্রযোজ্য রয়েছে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার কিছু প্রধান শর্ত রয়েছে।
কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য চারটি প্রধান শর্ত রয়েছে। কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য যে চারটি প্রধান সত্য রয়েছে সেগুলো হচ্ছে-
- মুসলিম হওয়া - কোরবানি ওয়াজিব হতে হলে প্রথমত মুসলিম হতে হবে। অমুসলিমদের ওপর কোরবানি কখনোই ওয়াজিব হয় না। তাই কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার প্রথম সত্য মুসলিম হওয়া।
- প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া - যে ব্যক্তি কোরবানি করবেন তাকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। অর্থাৎ ভালো মন্দ বিচার করার জ্ঞান থাকতে হবে। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৫ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ৯ বছর বয়স হতে হবে।
- সুস্থ মস্তিষ্ক এবং জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া - যে ব্যক্তি কোরবানি করবেন তাকে সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে। কেননা একজন উম্মাদের কোরবানি কখনোই কবুল হবে না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সুস্থ মস্তিষ্কের এবং জ্ঞান সম্পন্ন তার ক্ষেত্রে কোরবানি ওয়াজিব হবে।
- নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া - যে ব্যক্তি কোরবানি করবেন তাকে অন্ততপক্ষে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে। নেসাব পরিমাণ সম্পদ বলতে বুঝায় সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা এর সমমূল্য সম্পদ বা অর্থ।
এই চারটি গুণ যে ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে সে ব্যক্তির জন্য কোরবানি ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ কোরবানি ওয়াজিব হতে হলে এ চারটি গুন সে ব্যক্তির মধ্যে থাকতে হবে। তাছাড়া কোরবানি ওয়াজিব হবে না।
কুরবানির দিনে কুরবানি হওয়ার আগ পর্যন্ত না খেয়ে থাকার কি কোনো নিয়ম আছে
কুরবানীর দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কোন কিছু না খাওয়া সুন্নত। বরং ঈদের সালাত শেষে খাওয়া উত্তম। বিশেষ করে যদি ঈদের সালাত শেষে কুরবানীর গোস্ত খাওয়া হয় তাহলে তা অধিক উত্তম। হাদীসে এসেছে,
عن بريدة رضي الله عنه قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم لا يخرج يوم الفطر حتى يأكل، ولا يأكل يوم الأضحى حتى يرجع فيأكل من أضحيته. أحمد: ১৪২২ وصححه الألباني في صحيح ابن ماجه
বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কুরবানীর গোশত খেতেন।[শাইখ আলবানী রচিত, সহীহ ইবনে মাজাহ: হাদীস নং ১৪২২ ]
যে ব্যক্তি কুরবানী করবে তার জন্য এই বিধান প্রযোজ্য হবে। হাদীসের ভাষা থেকে এটাই স্পষ্ট হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরবানী করবে না সে ঈদের পূর্বে খেতে পারে। ইমাম যাইলাঈ তাবঈনুল হাকায়েক গ্রন্থে, আল্লামা মোবারকপূরী তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থে এবং আরও একদল আলেম হাদীসের আলোকে উপরোক্ত মত ব্যক্ত করেছেন।) আল্লাহু আলাম।
SM TECHY এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url